উখিয়ায় ফেলনা থেকেই আসছে বিদ্যুৎ!

ওয়াহিদুর রহমান রুবেল, কক্সবাজার :

বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের মধ্য দিয়ে সমন্বিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার (ওমনি প্রসেসর) যুগে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর।

ফলে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিক থেকে তৃতীয় দেশ হিসেবে তালিকায় স্থান করে নিল বাংলাদেশ।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, প্রকল্পে প্রতিদিন সাড়ে ১১ টন বর্জ্য ব্যবহার করা হচ্ছে। বিপরীতে উৎপাদন হচ্ছে ৪০-৫০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ, ১ হাজার ২০০ লিটার ডিসটিলড ওয়াটার এবং ১ হাজার ৫০০ কেজি ছাই। এ প্রকল্প চালু থাকলে পরিবেশ দূষণ কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে থাকবে বলে মনে করেন পরিবেশবিদরা।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী তুষার মোহন সাধু খাঁ বলেন, দেশে প্রথমবারের মতো প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এরই মধ্যে সুফল পেয়েছি। দাতা সংস্থা এবং সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলের সিদ্ধান্তে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

২০১৭ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে পালিয়ে উখিয়া-টেকনাফে আশ্রয় নেয় প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা। তাদের জন্য ধ্বংস করা হয় প্রায় আট হাজার হেক্টর বনভূমি। বিশাল এ জনগোষ্ঠীর পয়ঃজৈব এবং রোহিঙ্গাদের ব্যবহৃত প্লাস্টিক বর্জ্যের কারণে নষ্ট হচ্ছে পরিবেশ ও প্রতিবেশ। এ অবস্থায় রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও আশপাশের এলাকায় পরিবেশ এবং প্রতিবেশ রক্ষা করতে জরুরি সহায়তা প্রকল্পের আওতায় সমন্বিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা অর্থাৎ বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প গ্রহণ করে সরকার। এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সহায়তায় ২০২১ সালে ৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্প-৪ এক্সটেনশনে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। ২০২৩ সালের ১০ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ প্রকল্পের উদ্বোধন করেন।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এটি আমার স্বপ্নের প্রকল্প। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অতিরিক্ত বর্জ্যের কারণে পরিবেশ ও প্রতিবেশ হুমকির মুখে পড়তে পারে—এমন আশঙ্কা থেকে ‘ওমনি প্রসেসর’ নামে একটি প্রকল্পের প্রস্তাব দিই। এই প্লান্টটি সম্পূর্ণভাবে চালু রাখতে হলে প্রতিদিন ৬ টন ফেকাল স্লাজ, ৫ টন জৈববর্জ্য ও ৫০০ কেজি সিঙ্গেল লেয়ার প্লাস্টিক প্রয়োজন। যেহেতু রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কিছু বিধিনিষেধ রয়েছে, সেহেতু প্রকল্পটি দিনে ১০-১২ ঘণ্টা চালিয়ে রাখা সম্ভব হয়। ৬০-৭০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা থাকলেও বর্তমানে প্রতিদিন ৪০-৫০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ, ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ লিটার পানি এবং ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ কেজি ছাই উৎপাদন হচ্ছে। প্রকল্পটি পুরোপুরি চালু করা গেলে এখানে উৎপাদিত বিদ্যুৎ অন্য এলাকায় সরবরাহ করার পাশাপাশি উৎপাদিত পানি বিক্রি করেই ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভব। পাশাপাশি পরিবেশ বিপর্যয় নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় এক লাখ মানুষ সরাসরি উপকারভোগী হবে।

ওমনি প্রসেসর প্রকল্পের প্লান্ট ইনচার্জ মোহাম্মদ আলীউল হক বলেন, মানুষের পয়ঃবর্জ্য এবং পচনশীল ও অপচনশীন ময়লা-আবর্জনা, প্লাস্টিকের ক্ষতিকারক কার্বন ও গ্যাস পরিবেশের জন্য হুমকি। কিন্তু ওমনি প্রসেসরের মাধ্যমে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। এটি সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব প্রক্রিয়া। সেনেগাল এবং ভারতের পর তৃতীয় দেশ হিসেবে বাংলাদেশে এভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। এই প্লান্টটি সম্পূর্ণ অটোমেটিক হওয়ায় জনশক্তি খুবই কম লাগে। এ ছাড়া এ প্লান্টটি চালাতে বাইরের কোনো বিদ্যুৎ লাগে না। উৎপাদিত বিদ্যুৎ থেকেই এটি চালানো হয়।

পরিবেশবাদী সংগঠনের নেতা সায়ীদ আলমগীর বলেন, বিশাল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ব্যবহৃত প্লাস্টিক থেকে শুরু করে জৈব, অজৈব, পয়ঃবর্জ্য পরিবেশ ও প্রতিবেশে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এ প্রকল্পে প্রতিদিন যে পরিমাণ বর্জ্য ব্যবহার হচ্ছে তাতে পরিবেশের ক্ষতি কিছুটা কমিয়ে আনা যাবে। তবে তা যথেষ্ট নয়। এ ধরনের প্রকল্প আরও নেওয়া যায় কি না তা খতিয়ে দেখা দরকার।

প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ গোলাম মুক্তাদির বলেন, এডিবির সহযোগিতায় ওমনি প্রসেসর প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এটি সরাসরি পরিবেশবান্ধব প্রকল্প। অন্য প্রকল্পে যে পরিমাণ জমির প্রয়োজন হয়, এখানে তার চেয়ে

৭৫-৮০ শতাংশ কম জমি লাগে। তবে চ্যালেঞ্জ হবে প্রকল্পটি পরিচালনার জন্য দক্ষ লোকবলের। এই প্রকল্পের আয়-ব্যয় ও পরিবেশেও ওপর এর কেমন প্রভাব পড়ছে তা নিয়ে আমরা কাজ করছি। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর সবকিছু স্বাভাবিক থাকলে পরবর্তী প্রকল্পের প্রস্তাব করা হবে।